অতিরিক্ত ওজন কিংবা বাজে খাদ্যাভ্যাসই একমাত্র কারণ নয় যা আপনাকে ডায়াবেটিসের দিকে ধাবিত করতে পারে। আপনি জেনে বিস্মিত হবেন যে, কিছু দৈনিক অভ্যাস আপনাকে এই রোগ বিকশিত হওয়ার ঝুঁকিতে রাখতে পারে।
* আপনি সবসময় গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন : যদি গভীর রাত আপনার প্রিয় সময় হয়, তাহলে আপনি নিজেকে ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে রাখছেন। কোরিয়ান সাম্প্রতিক একটি গবেষণা অনুসারে, ‘যারা সকালের প্রারম্ভিক ঘণ্টা পর্যন্ত জেগে থাকেন তাদের ডায়াবেটিস বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা যারা তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যায় তাদের তুলনায় বেশি, এমনকি তারা সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুম গেলেও। গবেষণা লেখক ন্যান হি কিম বলেন, ‘যারা গভীর রাত পর্যন্ত নিদ্রাহীন থাকেন তারা উচ্চমাত্রায় টেলিভিশন ও সেল ফোনের কৃত্রিম আলো এক্সপোজ করেন, এ অভ্যাসটি নিম্ন ইনসুলিন সেনসিটিভিটি ও নিম্ন রক্ত শর্করার নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।’ গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকার সঙ্গে নিম্ন স্লিপ কোয়ালিটি এবং ঘুমের ঘাটতিরও সংযোগ রয়েছে, যা আপনার বিপাক ব্যাহত করতে পারে।
* আপনার ডায়েটে প্রোবায়োটিক কম থাকে : ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের এন্ডোক্রিনোলজিস্ট বেতুল হাতিপোগলু বলেন, ‘আপনার অন্ত্রে ভালো ব্যাকটেরিয়ার তুলনায় খারাপ ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বেড়ে গেলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে।’ ভালো হজমের জন্য আপনার পাকস্থলীতে প্রোবায়োটিক নামক উপকারী ব্যাকটেরিয়া প্রয়োজন; এদের পরিমাণ কমে গেলে প্রদাহ হতে পারে, যা শেষপর্যন্ত ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের দিকে ধাবিত করতে পারে। প্রোবায়োটিক বৃদ্ধি করতে দই, সাউয়ের ক্রাউট ও পনিরের মতো খাবার খান।
* আপনি অবশিষ্ট খাবার প্লাস্টিকের পাত্রে মাইক্রোওয়েভে গরম করেন : টেকআউট কন্টেইনার বর্জন করার ভালো কারণ রয়েছে: এসবের মধ্যে খাবার পুনরায় তাপ দেওয়া আপনার ডায়াবেটিস বিকশিত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। নিউ ইয়র্ক সিটির এনওয়াইইউ ল্যানগোন মেডিক্যাল সেন্টারের গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন যে, প্লাস্টিক র্যাপ ও প্লাস্টিক টেকআউট কন্টেইনার উৎপাদনে দুই ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় যা শিশু-কিশোরদের ডায়াবেটিসের বর্ধিত ঝুঁকির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল। এসব কেমিক্যাল ডায়াবেটিসের অগ্রদূত ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বৃদ্ধি করেছে এবং পাশাপাশি রক্তচাপও।
* আপনি পর্যাপ্ত সময় সূর্যালোকে থাকেন না : নিজেকে সূর্যের ক্ষতিকর ক্যানসার-সৃষ্টিকারক রশ্মি থেকে রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সূর্যের আলো থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থাকা আপনাকে ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে রাখে। একটি নতুন স্প্যানিশ গবেষণা অনুসারে, ভিটামিন ডি’র ঘাটতি থাকা লোকদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও প্রিডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, তাদের ওজন যেমনই হোক না কেন। গবেষকরা ধারণা করছেন যে সানশাইন ভিটামিন বা ভিটামিন ডি আপনার অগ্ন্যাশয়ের কার্যক্রম ঠিকভাবে হওয়ার জন্য ভূমিকা পালন করে, অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন উৎপাদন করে এবং রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ডা. হাতিপোগলু ভিটামিন ডি’র মাত্রা বাড়ানোর জন্য সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে পরামর্শ দিচ্ছেন এবং সেইসঙ্গে স্যালমন ও ভিটামিন ডি-ফর্টিফাইড দুধ বা সিরিয়ালের মতো ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার।
* আপনি টিভি দেখে ছুটির দিন কাটান : আপনি টিভি দেখে ছুটির দিন অতিবাহিত করবেন কিনা পুনরায় বিবেচনা করুন। ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গের একটি গবেষণায় পাওয়া গেছে, টিভির সামনে কাটানো প্রত্যেকটি ঘণ্টা আপনার ডায়াবেটিস বিকশিত হওয়ার ঝুঁকি প্রায় ৪ শতাংশ বৃদ্ধি করে। চ্যাপম্যান ইউনিভার্সিটির কিনেশিয়োলজির অধ্যাপক এরিক স্টার্নলিশট বলেন, ‘অত্যধিক বসে থাকা ভিসচেরাল ফ্যাট বা পেটের ভেতরের অর্গানে চর্বি জমার দিকে চালিত করে, যা আপনার কোমরের পরিধি বৃদ্ধি করে।’ পেটের অতিরিক্ত ওজন আপনার শরীরের ইনসুলিন সেনসিটিভিটি হ্রাস করে আপনার ডায়াবেটিস বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে।
* আপনি সকালে নাস্তা করেন না : ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক ডায়াবেটিস সেন্টারের ডায়াবেটিস এডুকেটর এলেন ক্যালোজেরাস বলেন, ‘সকালের খাবার এড়িয়ে যাওয়া আপনাকে পরবর্তীতে কেবলমাত্র অত্যধিক ক্ষুধার্তই করে না, টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকিও বৃদ্ধি করে।’ যখন আপনি আপনার শরীরকে খাবার থেকে বঞ্চিত করবেন, আপনার ইনসুলিনের মাত্রা ব্যাহত হবে এবং এটির পক্ষে রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।
* আপনি হোলসাম কার্বোহাইড্রেট পরিহার করেন : ভার্জিনিয়ার ডায়েটিশিয়ান এবং প্রিডায়াবেটিস: এ কমপ্লিট গাইড’র লেখক জিল ওয়েইজেনবার্জার বলেন, ‘লোকজন এটা শুনে বিস্মিত হয় যে কার্বোহাইড্রেট বর্জন টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের ওপর ভিত্তি করে প্রিডায়াবেটিস ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস চিহ্নিত করা হয়।’ স্যাচুরেটেড ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার (যেমন- বাটার ও উচ্চতাপে রান্নাকৃত মাংস) ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বৃদ্ধি করে। তিনি যোগ করেন, ‘ওট ও বার্লির মতো হোল গ্রেন ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স উন্নত করে।’ অন্যান্য কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার যেমন- দই, বেরি, মসুর ডাল, কালো শিম ও ছোলা ভালোভাবে রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণ করা ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস কম হওয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তাই কার্বোহাইড্রেট সম্পূর্ণরূপে পরিহার করার পরিবর্তে বিভিন্ন হোলসাম ফুড খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন ওয়েইজেনবার্জার।
* আপনার শাকসবজি ও কার্বোহাইড্রেটের সমন্বয় সঠিক নয় : যেকোনো ডায়েটের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে শাকসবজি। কিন্তু আপনার ডিনার প্লেটে ভারসাম্য রক্ষার জন্য জানা প্রয়োজন যে কোনটি শ্বেতসারবহুল। রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ান, সেলিব্রিটি নিউট্রিশনিস্ট ও মিডিয়া এক্সপার্ট লিসা ডিফাজিও বলেন, ‘মটর ও ভুট্টার মতো শ্বেতসারবহুল শাকসবজি, শাকসবজির তুলনায় কার্বোহাইড্রেট হিসেবে বেশি কাউন্ট হয়। প্রতিনিয়ত ভাত ও এসব শ্বেতসারবহুল শাকসবজি ভোজন ওজন ও রক্ত শর্করা বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে, যা আপনার ডায়াবেটিস বিকশিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
* আপনি অধিকাংশ ক্যালরি রাতে খান : ডিফাজিও বলেন, যেসব অভ্যাস ওজন বৃদ্ধিতে অবদান রাখে তা আপনার ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকিও বৃদ্ধি করে। এমন একটি অভ্যাস হচ্ছে- রাতে বেশিরভাগ ক্যালরি খাওয়া। ডিফাজিও বলেন, ‘রাতে অধিকাংশ ক্যালরি ভোজন ওজন বৃদ্ধির কারণ হতে পারে, কারণ আপনি ক্যালরি নিয়ে ঘুমাচ্ছেন।’ ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার পেরেলম্যান স্কুল অব মেডিসিন দ্বারা পরিচালিত একটি গবেষণা অনুসারে, রাতে দেরি করে ভোজন গ্লুকোজ ও ইনসুলিনের মাত্রা বৃদ্ধি করে, যাদের উভয় টাইপ-২ ডায়াবেটিস সৃষ্টি করে।
* আপনি শিডিউলড ওয়ার্কআউটের বাইরে অন্যকিছু করেন না : ওয়েইজেনবার্জার বলেন, ‘আপনার সারাদিনের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করা গুরুত্বপূর্ণ। দিনে কেবলমাত্র একবার সক্রিয় হওয়া ডায়াবেটিস প্রতিরোধের জন্য যথেষ্ট নয়। ভালোভাবে রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণের জন্য আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন দীর্ঘ সময়ের নিষ্ক্রিয়তা ভাঙার জন্য তিন মিনিট সক্রিয় হতে সাজেস্ট করছে- প্রতি ৩০ মিনিট পরপর তা করুন।’ তিনি অফিসের আশেপাশে হাঁটতে কিংবা কিছু স্ট্রেচ করতে পরামর্শ দিচ্ছেন।